বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও প্রমথ চৌধুরীর অবদানের খুঁটিনাটি


বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সংক্ষিপ্ত  পরিচিতি:

জন্ম : 

১৮৩৮ খ্রি: মৃত্যু : ১৮৯৪ খ্রি:

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : 

পণ্ডিত ভবানীচরণ বিদ্যাভূষণের দৌহিত্র ও যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার কাঁঠালপাড়া গ্রামে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র বারো বছর বয়সে গ্রামের পাঁচ বছর বয়সী একটি বালিকার সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের বিয়ে হয়। 

শিক্ষাজীবন: 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই প্রেসিডেন্সী কলেজে (১৮৫৪) আইন শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭) প্রবর্তিত সর্বপ্রথম এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন । বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম বি.এ. পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন । 

কর্মজীবন:

তিনি যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর (১৮৫৮) নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের বিভাগীয় কমিশনারের একান্ত সহকারী নিযুক্ত হন। পরবর্তী বছর (১৮৮১) তিনি বেঙ্গল গভর্নমেন্টের এ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারী হিসেবে কোলকাতায় স্থানান্তরিত হন।

উপাধি: 

বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে CLE (Companion of the Indian Empire) উপাধিতে ভূষিত হন। 

মৃত্যু: 

বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন।

সাহিত্যে অবদান: 

কাব্যচর্চার মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য-জীবনের সূত্রপাত হলেও বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক শিল্পসম্মত উপন্যাস-রচনার গৌরব তাঁর। বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬) ও মৃণালিনী (১৮৬৯) প্রকাশিত হলে সাহিত্য জগতে নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম কীর্তি 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকা (১৮৭২-৭৬) প্রকাশ ও সম্পাদনা। 

বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-জীবনে এই পত্রিকার প্রভাব অপরিসীম। এতে বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, কাব্য, সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, অর্থনীতি, সঙ্গীত, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ক আলোচনা প্রকাশিত হতো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের মিলন সাধন করেন । তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম তুলনামূলক সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধও রচনা করেন । বিদ্যাসাগরের সংস্কৃতানুসারী ভাষা ও আলালী কথ্য বাক-ভঙ্গি নতুনভাবে বিন্যস্ত করে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা গদ্যকে মর্মস্পর্শী ও সুষমামণ্ডিত করে তোলেন। 

উপরোল্লিখিত উপন্যাসগুলি ছাড়াও তিনি বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮) প্রভৃতি উপন্যাস এবং লোকরহস্য (১৮৭৪), কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫), বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬) ইত্যাদি প্রবন্ধ-গ্রন্থ রচনা করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চৌত্রিশ



 বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর অবদানের খুঁটিনাটি


প্রমথ চৌধুরী এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:

জন্ম: 

১৮৬৮ খ্রি: - মৃত্যু: ১৯৪৬ খ্রি:

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : 

প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দুর্গাদাস চৌধুরী পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামের জমিদার বংশের সন্তান । তাঁর শৈশব ও কৈশোরের কিছুকাল অতিবাহিত হয় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। 

শিক্ষাজীবন: 

প্রমথ চৌধুরী কোলকাতা হেয়ার স্কুল (১৮২৩) থেকে এন্ট্রান্স এবং প্রেসিডেন্সী কলেজ (১৮৫৪) থেকে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে দর্শনে প্রথম শ্রেণীতে বি.এ পাস করেন। অতঃপর তিনি ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. পাশ করে ইংল্যান্ড যান (১৮৯৩)। 

কর্মজীবন:

ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে প্রমথ চৌধুরী স্বল্পকালের জন্য কোলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দ্রিরা দেবীকে বিবাহ করেন। কিছুকাল প্রমথ চৌধুরী আইন কলেজেও অধ্যাপনা করেন। প্রমথ চৌধুরী ১৯২৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত 'নিখিল ভারত বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনেও সভাপতি নির্বাচিত হন। 

উপাধি: 

প্রমথ চৌধুরী ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'জগত্তারিণী পদক' লাভ করেন। তিনি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গিরিশ ঘোষ' বক্তৃতায় বাংলা সাহিত্যের পরিচয় দেন। 

মৃত্যু: 

প্রমথ চৌধুরী ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ২০ সেপ্টেম্বর শান্তি নিকেতনে পরলোক গমন করেন ।

বাংলা সাহিত্যে অবদান: 

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রমথ চৌধুরীর দান অবিস্মরণীয়। তিনিই প্রথম বাংলা ভাষার চলিত রূপকে সাহিত্যসৃজনে প্রয়োগ করেন। মার্জিত রুচি, বুদ্ধির দীপ্তি, অপূর্ব বাকচাতুর্য ও স্মিত রসিকতায় প্রমথ চৌধুরীর সমপর্যায়ের লেখক বাংলা সাহিত্যে বিরল। 

ভারতী (১৮৭৭) পত্রিকায় প্রকাশিত 'হালখাতা' তাঁর চলিত রীতির প্রথম রচনা। প্রমথ চৌধুরী ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে চলিত রীতিতে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সবুজপত্রকেন্দ্রিক ভাষা ও সাহিত্যাদর্শ আন্দোলনে তাঁকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয় । এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সমর্থক। সবুজপত্রের ভাব ও ভাষা-আন্দোলন দ্বারা তিনিও প্রভাবিত হন। 

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: 

'প্রমথনাথ সবুজপত্রকে যে একটি বিশিষ্টতা দিয়েছিলেন, তাতে আমার তখনকার রচনাগুলি সাহিত্য সাধনায় একটি নূতন পথে প্রবেশ করতে পেরেছিল। সবুজপত্রে সাহিত্যের এই একটি নূতন ভূমিকা রচনা প্রমথের প্রধান কৃতিত্ব । আমি তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করতে কখনও কুণ্ঠিত হইনি।'

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ:

সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৩), বীরবলের হালখাতা (১৯১৬), চার ইয়ারী কথা (১৯১৬), পদ-চারণ (১৯১৯) তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। প্রমথ চৌধুরীর 'গল্পসংগ্রহ' প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর বিশ্বভারতী থেকে দুই খণ্ডে প্রমথ চৌধুরীর 'প্রবন্ধ সংগ্রহ' প্রকাশিত হয়েছে (১৯৫২-৫৩) ।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post