বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুঁটিনাটি (জেনে নিন)

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য জীবনের খুঁটিনাটি


[জন্ম : ১৮৬১ খ্রি: - মৃত্যু : ১৯৪১ খ্রি:]


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচিতি : 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ বাংলা) কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। মাতার নাম সারদা দেবী। বাল্যকালে ওরিয়েন্টাল সেমিনারী, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমী, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যাশিক্ষার জন্য তাঁকে পাঠানো হলেও তিনি স্কুলের পাঠ শেষ করতে পারেননি।

স্কুলের প্রথাগত শিক্ষা তাঁর না হলেও বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে জ্ঞানার্জনে কোন ত্রুটি ঘটেনি । ১৭ বছর বয়সে একবার ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য তাঁকে বিলাত পাঠানো হয় । কিন্তু দেড় বছর পর পিতার আদেশে তিনি দেশে ফিরে আসেন ।

তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা 'হিন্দুমেলার উপহার' (১২৮১)। তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিনী' এবং প্রথম উপন্যাস 'করুণা' ভারতী (১৮৭৭)-র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তিনি ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে 'সারস্বত সম্মেলন'-এর সম্পাদক হন এবং এ সময়ই তিনি 'নির্ঝরের স্বপ্নভগ্ন' কবিতাটি রচনা করেন। 'সন্ধ্যা সঙ্গীত' (১৮৮২) প্রকাশিত হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বঙ্গিমচন্দ্রের কাছ থেকে জয়মাল্য লাভ করে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে ও অন্যান্য:

২২ বছর বয়সে জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর কন্যা ভবতারিণী (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী)-র সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় (১৮৮৩)। তিনি ১৮৮৪ থেকে পিতার আদেশে বিষয়কর্ম পরিদর্শনে নিযুক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারি দেখাশুনা করেন। এই সূত্রে শিলাইদহ, সাহাজাদপুর কুঠিবাড়ির নাম বাঙালি পাঠকদের কাছে পরিচিত হয়ে আছে। 

পুত্র রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই রবীন্দ্রনাথের বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি (১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯০১)-এ রূপান্তরিত হয়েছে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে তিনি একটি শুভাযাত্রা পরিচালনা ও রাখী উৎসব প্রচলন করেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (১৯১৯)-এর প্রতিবাদে তিনি সরকার প্রদত্ত ‘নাইট' (Knight) উপাধি বর্জন করেন ।

নোভেল বিজয় ও উপাধি:

১৯১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ড যান। এ সময় মে সিনক্লেয়ার, এজরা পাউন্ড, ইয়েটস প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় অতঃপর তিনি আমেরিকা ভ্রমণে গিয়ে বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা করেন । ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং অক্টোবর মাসে এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। 

এ সময় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডক্টরেট' (১৯১৪) এবং তৎকালীন ভারত সরকার 'স্যার' (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শান্তি নিকেতনে একটি বিশেষ সমাবর্তনের আয়োজন করে রবীন্দ্রনাথকে 'ডক্টরেট' ডিগ্রী প্রদান করে।

ভ্রমণ:

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে তিনি জাপান, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি স্থানে যান। চীনের নতুন প্রজাতন্ত্রী সরকারের আমন্ত্রণে ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথ চীনে গিয়েছিলেন। ১৯২৬-এ মুসোলিনীর আমন্ত্রণে ইতালিতে গিয়ে শিল্পতত্ত্ববিদ বেনেদেত্তো ক্রোচে ও ফরাসী মনীথী রোমাঁ রোলাঁর সঙ্গে পরিচিত হন। 

তিনি সারা ইউরোপ ভ্রমণ ও বক্তৃতা করে ফেরার পথে কায়রো হয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৭-এ ওলন্দাজ অধ্যাপক বাক-এর নিমন্ত্রণে দূরপ্রাচ্য সফর করেন। শিক্ষা-বিশেষজ্ঞদের সম্মেলনে যোগদানের জন্য ১৯২৯-এ তিনি কানাডা গমন করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া এবং পরে পারস্য ভ্রমণ করেন। 

প্যারিসে ওকাম্পোর অর্থানুকূল্যে এবং কঁতেস দ্য নোয়াই-এর সাহায্যে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। বার্লিনেও রবীন্দ্রনাথের ছবি প্রদর্শিত হয়। সেখানে তিনি বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনের সঙ্গে আলোচনা করেন। রাশিয়া ভ্রমণকালে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার সমাজ, বিশেষ করে তার শিক্ষা-ব্যবস্থা রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল । তিনি ১৯৩৪-এ শেষবার সিংহল ভ্রমণ করেন।  বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের জন্মদিনে 'সভ্যতার সংকট' প্রবন্ধ পাঠ করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা সাহিত্যে অবদান: 

রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলা ভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করে নেয়। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার ও নাট্য প্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। 

বিজ্ঞানে তাঁর অপরিসীম আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর 'বিশ্বপরিচয়' গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথ রচিত দুই হাজারের উপর গানের স্বরলিপি আজও প্রকাশিত হচ্ছে। দুই স্বাধীন রাষ্ট্র- ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বাংলা ) কোলকাতায় রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটে।

বিশ্বভারতী ২৯ খণ্ডে রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রকাশ করেছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুলির মধ্যে মানসী (১৮৯০), সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬), ক্ষণিকা (১৯০০), গীতাঞ্জলি (১৯১০), বলাকা (১৯১৫), পূরবী (১৯২৫), পুনশ্চ (১৯৩২), সেঁজুতি (১৯৩৮) প্রভৃতি; উপন্যাসের মধ্যে চোখের বালি (১৯০৩), 

নৌকাডুবি (১৯০৬), গোরা (১৯১০), চতুরঙ্গ (১৯১৬), ঘরে-বাইরে (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯); এবং নাটকের মধ্যে বিসর্জন (১৮৮৯), রাজা (১৯১০), ডাকঘর (১৯১২), রক্তকরবী (১৯২৬) প্রভৃতি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । সাহিত্য (১৯০৭), বিচিত্র প্রবন্ধ (১৯০৭), স্বদেশ (১৯০৮), সমাজ (১৯০৮), শিক্ষা (১৯০৮), ধৰ্ম (১৯০৯), সংকলন (১৯২৫), সাহিত্যের পথে (১৯৩৬), কালান্তর (১৯৩৭) প্রভৃতি রবীন্দ্রনাথের যুগন্ধর ও যুগাতিক্রমী প্রবন্ধগ্রন্থ



Post a Comment

Previous Post Next Post