আইজ্যাক নিউটন এর জীবনী – Isaac Newton Biography in Bengali
মৃত্যু : ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দএবার আমরা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর প্রতিভা স্যার আইজ্যাক নিউটনের ছোটোবেলার গল্প বলব।নিউটনের ছোটোবেলা কেটে গিয়েছিল অনিশ্চিত অন্ধকারের মধ্যে। জন্মের প্রাক্-মুহূর্তে বাবাকে হারিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর বিড়ম্বনার। তিনি নিজেও মায়ের গর্ভে থাকতেই নানা জটিলতায় মৃত্যুকে প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন। ডাক্তাররা বলেছিলেন, জন্মের কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিউটন মারা যাবেন। মারা তো তিনি যাননি। বরং জগৎকে তখন থেকেই চমকিত করতে থাকেন। শেষ অব্দি পরিণত বয়সে একের পর এক জটিল বিষয়ের মৌল সূত্র আবিষ্কার করে বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন নিজের সমুজ্জ্বল আসনটি।অথচ প্রথম জীবনে রুগ্ণ নিউটনের দায়িত্ব নিতে রাজি হননি তাঁর বি-পিতা পাদ্রীসাহেব। বাধ্য হয়ে তাঁর মা তাঁকে রেখে আসেন ঠাকুমার কাছে—উলসথরপের খামার বাড়িতে। ঠাকুমার কাছে তিনি স্নেহ পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন প্রশ্রয়। কিন্তু একটা একাকীত্বের শূন্যতা তাঁকে সবসময় গ্রাস করত। বাবা-মা নেই, কোনো ভাইবোন নেই। এভাবে একলা একলা কি বেঁচে থাকা যায়? তাই প্রকৃতির মাঝে খুঁজে নিয়েছিলেন নিজের ভালো লাগাগুলিকে। সবুজ শ্যামল বনানীর মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন একা একা। গাছগাছালির সাথেই সখ্যতার সুমধুর সম্পর্ক পাতিয়েছিলেন আইজ্যাক নিউটন। মাঝে মধ্যে একা একা গাছের সঙ্গে কথা বলতেন। কাঠবেড়ালির নাচন দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠত তাঁর। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি অনেকদুর চলে যেতেন। ভালোভাবে হাঁটতে পারতেন না। এমনই দুর্বল ছিলেন ছ বছরের বালক নিউটন।ঠাকুমা গল্প বলতেন। কত গল্প—রূপকথার গল্প, আকাশের গল্প, দৈত্যদানবের গল্প। গল্প শুনতে শুনতে নিউটন একটা অদ্ভুত জগতের বাসিন্দা হয়ে যেতেন। তিনি ভাবতেন, গল্পের জগৎ আর বাস্তব পৃথিবীর মধ্যে এত তফাৎ কেন?আশেপাশে সঙ্গীসাথী বলতে কেউ ছিল না বলেই বোধহয় পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তীক্ষ্ণ হয়েছিল আইজ্যাক নিউটনের। যে কোনো ঘটনার অন্তরালে কী কারণ লুকিয়ে আছে, তা জানতে ছটফট করতেন। এই অভ্যাস থেকেই একদিন তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, আপেল গাছ থেকে আপেল ফল পড়তে দেখে নিউটন মাধ্যাকর্ষণের সূত্র আবিষ্কার করেন। এইভাবে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানের ইতিহাসকে তিনি একেবারে বদলে দিয়েছিলেন।বারো বছর বয়সে ঠাকুমা নিউটনকে পাঠিয়ে দিলেন গ্রানথাম শহরে। সেখানে ক্লার্ক নামে তাঁর এক পরিচিত ভদ্রলোক ছিলেন। ঠাকুমা ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। উলস্থৰ্পে কোনো ভালো স্কুল নেই। এখানে থাকলে নিউটন হয়তো এক রাখাল বালকে পরিণত হবেন—কোনো ঠাকুমা কি তা চাইতে পারেন?ক্লার্কের স্ত্রী ছিলেন নিউটনের মায়ের বান্ধবী। তাঁর কাছেই নিউটন প্রথম মাতৃস্নেহের স্বাদ পেয়েছিলেন। মা কাকে বলে, নিউটন তা জানতেন না। কিন্তু শ্রীমতী ক্লার্ক তাঁকে মায়ের যত্নেই মানুষ করে তুলেছিলেন।ক্লার্ক ভদ্রলোক ওষুধের ব্যবসা করতেন। নিজের বাড়িতেই ছোট্ট একটা কারখানা ছিল তাঁর। সেদিনের বালক নিউটন সবসময় ওই কারখানাতে ঘুরঘুর করতেন। রসায়ন এবং পদার্থবিদ্যা তখন থেকেই তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। কীভাবে কীসের সঙ্গে কী মেশালে কী তৈরি হয়, তা জানতে ভীষণ কৌতূহল ছিল আইজ্যাক নিউটনের। এখানে বছর চারেক ছিলেন নিউটন। পরবর্তীকালে তিনি স্বীকার করেছেন, তাঁর বিজ্ঞানের ভিতটা এখানেই তৈরি হয়েছিল।ক্লার্কের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে একদিন দুপুরে একটি রত্নভাণ্ডার আবিষ্কার করে ফেলেন নিউটন। না, আমি মণিমুক্তো হিরে-জহরতের কথা বলছি না। আমি বলছি, বইয়ের রাজত্বের কথা। সেই চিলেকোঠাতে সব বিষয়ের অসংখ্য বই ছিল। বিশেষ করে ছিল চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন এবং সৌরজগত বিষয়ক বই। শ্রীযুক্ত ক্লার্ক বই পড়তে ভালোবাসতেন। অবসর সময় কাটাতেন শুধু গ্রন্থ অধ্যয়ন করে।দেখা গেল, নিউটন সবসময় চিলেকোঠার ঘরে বসে আছেন। বইয়ের পর বই পড়ছেন। সব বুঝতে পারছেন না। তবুও পড়ার উৎসাহে ঘাটতি নেই। পড়া ছাড়া বাকি সময় তিনি থাকতেন ওষুধ তৈরির ল্যাবরেটরিতে। কাচের যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক পদার্থ ভরতি শিশিবোতল নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন সময় সুযোগ পেলেই। চিলেকোঠার ঘরে বসেই সেদিনের কিশোর নিউটন একটির পর একটি যন্ত্র বানিয়েছিলেন। তৈরি করেছিলেন বাতাসি কলযন্ত্রের গাড়ি, জলঘড়ি, সূর্যঘড়ি-র নানা মডেল। কখনও আবার একতলার ল্যাবরেটরিতে নেমে এসে রাসায়নিক দ্রব্যের গুণাগুণ পরীক্ষা করতেন। এতে মাঝে মধ্যে ছোটোখাটো বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটত। শ্রীযুক্ত ক্লার্ক কিন্তু এই বালকটিকে কিছু বলতেন না। আহা, ওর বাবা মারা গেছেন, মা থেকেও নেই। প্রায় অনাথ এই বালকটিকে তিনি প্রাণ উজাড় করা ভালোবাসা উপহার দিয়েছিলেন।ষোলো বছর বয়সে নিউটনের কাছে আর-একটি দুঃসংবাদ এল। অবশ্য একে আমরা সঠিক অর্থে দুঃসংবাদ বলতে পারি না। উলসৰ্থপ থেকে মায়ের চিঠি পেলেন নিউটন। জানতে পারলেন, তাঁর নতুন বাবা মারা গেছেন। মা এখন জমিদারির ব্যাপার নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। নিউটন যেন এখনই উলসথর্পে চলে আসেন।ইতি ঘটে গেল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের। নিউটন হলেন উলসথর্পের বাসিন্দা। জমিদারির লাভ-ক্ষতি আর চাষ-আবাদের মধ্যে অল্প দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিলেন বেচারি নিউটন। সবসময় কি আর ভালো লাগে এইভাবে মামলা-মোকদ্দমার চিঠি তৈরি করতে। শেষ অব্দি মার কাছে মনের ইচ্ছের কথা জানালেন। তাঁর অনেক দিনের স্বপ্ন তিনি কলেজে ভরতি হবেন। লেখাপড়াতে ছেলের আগ্রহ দেখে মা খুশি হয়েছিলেন। নিউটনকে পাঠিয়ে দিলেন কেমব্রিজে। নিউটন সেখানকার বিশ্ববিখ্যাত কলেজ ট্রিনিটিতে ভরতি হলেন।এই কলেজে আইজ্যাক ব্যারো নামে অঙ্কের এক অধ্যাপক ছিলেন। অত্যন্ত ছাত্রবৎসল মানুষ ছিলেন তিনি। প্রত্যেকটি ছাত্রের সাথে বন্ধুর মতো মিশতেন। কার কোন দিকে মেধা তা সহজেই বুঝতে পারতেন। তিনিই প্রথম নিউটনের গুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পেয়েছিলেন।ব্যারো নিজে ছিলেন বিজ্ঞানের এক অসামান্য প্রতিভা। যদি শিক্ষক না হয়ে তিনি বিজ্ঞানী হতেন তাহলে তাঁর নাম সকলের মুখে মুখে ফিরত। কিন্তু পৃথিবীতে সব মানুষ তো আর বিজ্ঞানী হবার জন্য আসেন না। কেউ কেউ অধ্যাপনার মধ্যেই জীবনের সমস্ত সারাৎসার খুঁজে নেন। ব্যারো ছিলেন ওই দলের। ব্যারোর সুপারিশেই কলেজ কর্তৃপক্ষ নিউটনকে ছাত্রবৃত্তি দিয়েছিলেন। অঙ্ক নিয়ে গবেষণা করার জন্য নিউটন এই বৃত্তি পেয়েছিলেন।ব্যারোর সংস্পর্শে এসে নিউটনের মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জগৎটা কত বড়ো। কত মহান বিজ্ঞানী নানা বিষয়ে আবিষ্কার করেছেন। আমাকে তাঁদের উত্তরসুরী হতেই হবে—এটাই ছিল নিউটনের মনোগত বাসনা!অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি গণিতের মূলনীতিগুলিকে আত্মস্থ করে ফেলেছিলেন। তখন গণিতের ওপরেই তাঁর সমস্ত আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। গণিত ছাড়া যে অন্য কোনো বিষয় থাকতে পারে, সেকথা ভুলে গেছেন নিউটন। সারাদিন শুধু অঙ্ক নিয়ে গবেষণা করছেন, যেটুকু সময় হাতে পাচ্ছেন, তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া শেষ করছেন। বিশুদ্ধ গণিতের থেকে ব্যবহারিক গণিত তাঁকে বেশি আকর্ষণ করেছিল। এই গণিতের মধ্যে প্রকৃতি জগতের সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে-এমনটিই ভাবতেন নিউটন। নিউটন যে বছর বৃত্তি পেলেন সেই ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডজুড়ে প্লেগ দেখা দিয়েছিল মহামারির আকারে। কাতারে কাতারে মানুষ মারা গেলেন। দিশেহারা মানুষ লন্ডন শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করেছেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হল। লন্ডন ছেড়ে উলসথর্পের খামার বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন নিউটন।আবার সেই জমিদারির চাপ। টাকা, আনা, পাই-এর হিসেব নিকেশ। ভালো লাগছে না। কিছুই ভালো লাগছে না সেদিনের তরুণ নিউটনের। কিন্তু কী আর করবেন। দেড় বছর উলস্থৰ্পে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। তখনই এক এক করে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন নিউটন।তাঁর প্রথম আবিষ্কারটি ছিল বায়নোমিরাল থিয়োরেম অর্থাৎ দ্বিপদ তত্ত্ব নিয়ে। দ্বিতীয়টি ছিল ডিফারেনসিয়াল ক্যালকুলাস বা প্রভেদক গণনা নিয়ে। এই দুটি আবিষ্কারই তাঁকে সকলের কাছে পরিচিত করে দেয়। এরই পাশাপাশি আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন নিউটন। জ্যামিতি শাস্ত্রে শঙ্কু বা কোণ-এর একটি আলাদা পরিচিতি আছে। এই শঙ্কুর কোনো একটি অংশ যে বক্ররেখা বা কার্ড তৈরি করে, তার ক্ষেত্রফল ও ঘনবস্তুর আয়তনের পরিমাপের পদ্ধতিটিও তিনি আবিষ্কার করেন।জমিদারির কাজ আর নিজের গবেষণা নিয়ে কেটে গেল আঠারোটি মাস। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এল। নিউটন আবার কেমব্রিজে ফিরে এলেন। এবার শুরু হল তাঁর একটির পর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশের পালা।এভাবেই নিউটন বিশ্ববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন। আবিষ্কার করেছিলেন আলোর প্রতিসরণ সূত্র। তারপর প্রকাশ করলেন গতির তিনটি সূত্র। টানা দু-বন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রম করে আলোক বিজ্ঞানের ওপর তাঁর গবেষণাপত্রটি রচনা করেন। এটি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত বই ‘ফিলোজফিয়া নেচারিলিস ম্যাথামেটিকা তৈ। এইভাবেই তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসকে একেবারে পালটে দিয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন বিজ্ঞান হল যুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান, এখানে পূর্ব কল্পনার কোনো স্থান নেই।বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বীকৃতিতে তাঁকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই বিরল সম্মান লাভ করেছিলেন। জীবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে ছোটোবেলার দিনগুলোর কথা ভাবতেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। মন চলে যেত উলসথর্পের ওই খামারবাড়িতে। মনে পড়ে যেত পাহাড়ের সাথে সখ্যতা পাতানোর প্রহরের কথা। বর্ণরঙিন প্রজাপতির ওড়াউড়ি অথবা মৌমাছির গুনগুন গান—কোন্টা বেশি ভালো, গালে হাত দিয়ে ভাবতেন বিজ্ঞানীসম্রাট স্যার আইজ্যাক নিউটন। আর ভাবতেন, জন্মটাই তাঁর কাছে ঈশ্বরের একটা আশ্চর্য পরিহাস! মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন তিনি। আর শেষ অব্দি হাজার হাজার মানুষকে আলোর পথের পথিক করে গেলেন!
মৃত্যু : ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দ
এবার আমরা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর প্রতিভা স্যার আইজ্যাক নিউটনের ছোটোবেলার গল্প বলব।
নিউটনের ছোটোবেলা কেটে গিয়েছিল অনিশ্চিত অন্ধকারের মধ্যে। জন্মের প্রাক্-মুহূর্তে বাবাকে হারিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর বিড়ম্বনার। তিনি নিজেও মায়ের গর্ভে থাকতেই নানা জটিলতায় মৃত্যুকে প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন। ডাক্তাররা বলেছিলেন, জন্মের কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিউটন মারা যাবেন। মারা তো তিনি যাননি। বরং জগৎকে তখন থেকেই চমকিত করতে থাকেন। শেষ অব্দি পরিণত বয়সে একের পর এক জটিল বিষয়ের মৌল সূত্র আবিষ্কার করে বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন নিজের সমুজ্জ্বল আসনটি।
অথচ প্রথম জীবনে রুগ্ণ নিউটনের দায়িত্ব নিতে রাজি হননি তাঁর বি-পিতা পাদ্রীসাহেব। বাধ্য হয়ে তাঁর মা তাঁকে রেখে আসেন ঠাকুমার কাছে—উলসথরপের খামার বাড়িতে। ঠাকুমার কাছে তিনি স্নেহ পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন প্রশ্রয়। কিন্তু একটা একাকীত্বের শূন্যতা তাঁকে সবসময় গ্রাস করত। বাবা-মা নেই, কোনো ভাইবোন নেই। এভাবে একলা একলা কি বেঁচে থাকা যায়? তাই প্রকৃতির মাঝে খুঁজে নিয়েছিলেন নিজের ভালো লাগাগুলিকে। সবুজ শ্যামল বনানীর মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন একা একা। গাছগাছালির সাথেই সখ্যতার সুমধুর সম্পর্ক পাতিয়েছিলেন আইজ্যাক নিউটন। মাঝে মধ্যে একা একা গাছের সঙ্গে কথা বলতেন। কাঠবেড়ালির নাচন দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠত তাঁর। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি অনেকদুর চলে যেতেন। ভালোভাবে হাঁটতে পারতেন না। এমনই দুর্বল ছিলেন ছ বছরের বালক নিউটন।
ঠাকুমা গল্প বলতেন। কত গল্প—রূপকথার গল্প, আকাশের গল্প, দৈত্যদানবের গল্প। গল্প শুনতে শুনতে নিউটন একটা অদ্ভুত জগতের বাসিন্দা হয়ে যেতেন। তিনি ভাবতেন, গল্পের জগৎ আর বাস্তব পৃথিবীর মধ্যে এত তফাৎ কেন?
আশেপাশে সঙ্গীসাথী বলতে কেউ ছিল না বলেই বোধহয় পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তীক্ষ্ণ হয়েছিল আইজ্যাক নিউটনের। যে কোনো ঘটনার অন্তরালে কী কারণ লুকিয়ে আছে, তা জানতে ছটফট করতেন। এই অভ্যাস থেকেই একদিন তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, আপেল গাছ থেকে আপেল ফল পড়তে দেখে নিউটন মাধ্যাকর্ষণের সূত্র আবিষ্কার করেন। এইভাবে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানের ইতিহাসকে তিনি একেবারে বদলে দিয়েছিলেন।
বারো বছর বয়সে ঠাকুমা নিউটনকে পাঠিয়ে দিলেন গ্রানথাম শহরে। সেখানে ক্লার্ক নামে তাঁর এক পরিচিত ভদ্রলোক ছিলেন। ঠাকুমা ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। উলস্থৰ্পে কোনো ভালো স্কুল নেই। এখানে থাকলে নিউটন হয়তো এক রাখাল বালকে পরিণত হবেন—কোনো ঠাকুমা কি তা চাইতে পারেন?
ক্লার্কের স্ত্রী ছিলেন নিউটনের মায়ের বান্ধবী। তাঁর কাছেই নিউটন প্রথম মাতৃস্নেহের স্বাদ পেয়েছিলেন। মা কাকে বলে, নিউটন তা জানতেন না। কিন্তু শ্রীমতী ক্লার্ক তাঁকে মায়ের যত্নেই মানুষ করে তুলেছিলেন।
ক্লার্ক ভদ্রলোক ওষুধের ব্যবসা করতেন। নিজের বাড়িতেই ছোট্ট একটা কারখানা ছিল তাঁর। সেদিনের বালক নিউটন সবসময় ওই কারখানাতে ঘুরঘুর করতেন। রসায়ন এবং পদার্থবিদ্যা তখন থেকেই তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। কীভাবে কীসের সঙ্গে কী মেশালে কী তৈরি হয়, তা জানতে ভীষণ কৌতূহল ছিল আইজ্যাক নিউটনের। এখানে বছর চারেক ছিলেন নিউটন। পরবর্তীকালে তিনি স্বীকার করেছেন, তাঁর বিজ্ঞানের ভিতটা এখানেই তৈরি হয়েছিল।
ক্লার্কের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে একদিন দুপুরে একটি রত্নভাণ্ডার আবিষ্কার করে ফেলেন নিউটন। না, আমি মণিমুক্তো হিরে-জহরতের কথা বলছি না। আমি বলছি, বইয়ের রাজত্বের কথা। সেই চিলেকোঠাতে সব বিষয়ের অসংখ্য বই ছিল। বিশেষ করে ছিল চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন এবং সৌরজগত বিষয়ক বই। শ্রীযুক্ত ক্লার্ক বই পড়তে ভালোবাসতেন। অবসর সময় কাটাতেন শুধু গ্রন্থ অধ্যয়ন করে।
দেখা গেল, নিউটন সবসময় চিলেকোঠার ঘরে বসে আছেন। বইয়ের পর বই পড়ছেন। সব বুঝতে পারছেন না। তবুও পড়ার উৎসাহে ঘাটতি নেই। পড়া ছাড়া বাকি সময় তিনি থাকতেন ওষুধ তৈরির ল্যাবরেটরিতে। কাচের যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক পদার্থ ভরতি শিশিবোতল নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন সময় সুযোগ পেলেই। চিলেকোঠার ঘরে বসেই সেদিনের কিশোর নিউটন একটির পর একটি যন্ত্র বানিয়েছিলেন। তৈরি করেছিলেন বাতাসি কলযন্ত্রের গাড়ি, জলঘড়ি, সূর্যঘড়ি-র নানা মডেল। কখনও আবার একতলার ল্যাবরেটরিতে নেমে এসে রাসায়নিক দ্রব্যের গুণাগুণ পরীক্ষা করতেন। এতে মাঝে মধ্যে ছোটোখাটো বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটত। শ্রীযুক্ত ক্লার্ক কিন্তু এই বালকটিকে কিছু বলতেন না। আহা, ওর বাবা মারা গেছেন, মা থেকেও নেই। প্রায় অনাথ এই বালকটিকে তিনি প্রাণ উজাড় করা ভালোবাসা উপহার দিয়েছিলেন।
ষোলো বছর বয়সে নিউটনের কাছে আর-একটি দুঃসংবাদ এল। অবশ্য একে আমরা সঠিক অর্থে দুঃসংবাদ বলতে পারি না। উলসৰ্থপ থেকে মায়ের চিঠি পেলেন নিউটন। জানতে পারলেন, তাঁর নতুন বাবা মারা গেছেন। মা এখন জমিদারির ব্যাপার নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। নিউটন যেন এখনই উলসথর্পে চলে আসেন।
ইতি ঘটে গেল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের। নিউটন হলেন উলসথর্পের বাসিন্দা। জমিদারির লাভ-ক্ষতি আর চাষ-আবাদের মধ্যে অল্প দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিলেন বেচারি নিউটন। সবসময় কি আর ভালো লাগে এইভাবে মামলা-মোকদ্দমার চিঠি তৈরি করতে। শেষ অব্দি মার কাছে মনের ইচ্ছের কথা জানালেন। তাঁর অনেক দিনের স্বপ্ন তিনি কলেজে ভরতি হবেন। লেখাপড়াতে ছেলের আগ্রহ দেখে মা খুশি হয়েছিলেন। নিউটনকে পাঠিয়ে দিলেন কেমব্রিজে। নিউটন সেখানকার বিশ্ববিখ্যাত কলেজ ট্রিনিটিতে ভরতি হলেন।
এই কলেজে আইজ্যাক ব্যারো নামে অঙ্কের এক অধ্যাপক ছিলেন। অত্যন্ত ছাত্রবৎসল মানুষ ছিলেন তিনি। প্রত্যেকটি ছাত্রের সাথে বন্ধুর মতো মিশতেন। কার কোন দিকে মেধা তা সহজেই বুঝতে পারতেন। তিনিই প্রথম নিউটনের গুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পেয়েছিলেন।
ব্যারো নিজে ছিলেন বিজ্ঞানের এক অসামান্য প্রতিভা। যদি শিক্ষক না হয়ে তিনি বিজ্ঞানী হতেন তাহলে তাঁর নাম সকলের মুখে মুখে ফিরত। কিন্তু পৃথিবীতে সব মানুষ তো আর বিজ্ঞানী হবার জন্য আসেন না। কেউ কেউ অধ্যাপনার মধ্যেই জীবনের সমস্ত সারাৎসার খুঁজে নেন। ব্যারো ছিলেন ওই দলের। ব্যারোর সুপারিশেই কলেজ কর্তৃপক্ষ নিউটনকে ছাত্রবৃত্তি দিয়েছিলেন। অঙ্ক নিয়ে গবেষণা করার জন্য নিউটন এই বৃত্তি পেয়েছিলেন।
ব্যারোর সংস্পর্শে এসে নিউটনের মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জগৎটা কত বড়ো। কত মহান বিজ্ঞানী নানা বিষয়ে আবিষ্কার করেছেন। আমাকে তাঁদের উত্তরসুরী হতেই হবে—এটাই ছিল নিউটনের মনোগত বাসনা!
অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি গণিতের মূলনীতিগুলিকে আত্মস্থ করে ফেলেছিলেন। তখন গণিতের ওপরেই তাঁর সমস্ত আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। গণিত ছাড়া যে অন্য কোনো বিষয় থাকতে পারে, সেকথা ভুলে গেছেন নিউটন। সারাদিন শুধু অঙ্ক নিয়ে গবেষণা করছেন, যেটুকু সময় হাতে পাচ্ছেন, তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া শেষ করছেন। বিশুদ্ধ গণিতের থেকে ব্যবহারিক গণিত তাঁকে বেশি আকর্ষণ করেছিল। এই গণিতের মধ্যে প্রকৃতি জগতের সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে-এমনটিই ভাবতেন নিউটন। নিউটন যে বছর বৃত্তি পেলেন সেই ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড
জুড়ে প্লেগ দেখা দিয়েছিল মহামারির আকারে। কাতারে কাতারে মানুষ মারা গেলেন। দিশেহারা মানুষ লন্ডন শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করেছেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হল। লন্ডন ছেড়ে উলসথর্পের খামার বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন নিউটন।
আবার সেই জমিদারির চাপ। টাকা, আনা, পাই-এর হিসেব নিকেশ। ভালো লাগছে না। কিছুই ভালো লাগছে না সেদিনের তরুণ নিউটনের। কিন্তু কী আর করবেন। দেড় বছর উলস্থৰ্পে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। তখনই এক এক করে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন নিউটন।
তাঁর প্রথম আবিষ্কারটি ছিল বায়নোমিরাল থিয়োরেম অর্থাৎ দ্বিপদ তত্ত্ব নিয়ে। দ্বিতীয়টি ছিল ডিফারেনসিয়াল ক্যালকুলাস বা প্রভেদক গণনা নিয়ে। এই দুটি আবিষ্কারই তাঁকে সকলের কাছে পরিচিত করে দেয়। এরই পাশাপাশি আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন নিউটন। জ্যামিতি শাস্ত্রে শঙ্কু বা কোণ-এর একটি আলাদা পরিচিতি আছে। এই শঙ্কুর কোনো একটি অংশ যে বক্ররেখা বা কার্ড তৈরি করে, তার ক্ষেত্রফল ও ঘনবস্তুর আয়তনের পরিমাপের পদ্ধতিটিও তিনি আবিষ্কার করেন।
জমিদারির কাজ আর নিজের গবেষণা নিয়ে কেটে গেল আঠারোটি মাস। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এল। নিউটন আবার কেমব্রিজে ফিরে এলেন। এবার শুরু হল তাঁর একটির পর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশের পালা।
এভাবেই নিউটন বিশ্ববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন। আবিষ্কার করেছিলেন আলোর প্রতিসরণ সূত্র। তারপর প্রকাশ করলেন গতির তিনটি সূত্র। টানা দু-বন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রম করে আলোক বিজ্ঞানের ওপর তাঁর গবেষণাপত্রটি রচনা করেন। এটি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত বই ‘ফিলোজফিয়া নেচারিলিস ম্যাথামেটিকা তৈ। এইভাবেই তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসকে একেবারে পালটে দিয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন বিজ্ঞান হল যুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান, এখানে পূর্ব কল্পনার কোনো স্থান নেই।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বীকৃতিতে তাঁকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই বিরল সম্মান লাভ করেছিলেন। জীবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে ছোটোবেলার দিনগুলোর কথা ভাবতেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। মন চলে যেত উলসথর্পের ওই খামারবাড়িতে। মনে পড়ে যেত পাহাড়ের সাথে সখ্যতা পাতানোর প্রহরের কথা। বর্ণরঙিন প্রজাপতির ওড়াউড়ি অথবা মৌমাছির গুনগুন গান—কোন্টা বেশি ভালো, গালে হাত দিয়ে ভাবতেন বিজ্ঞানীসম্রাট স্যার আইজ্যাক নিউটন। আর ভাবতেন, জন্মটাই তাঁর কাছে ঈশ্বরের একটা আশ্চর্য পরিহাস! মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন তিনি। আর শেষ অব্দি হাজার হাজার মানুষকে আলোর পথের পথিক করে গেলেন!
Tags
biography